বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে কাজী নজরুল ইসলাম আপন স্বকীয়তায় দীপ্র। বাংলা কাব্যের চিরাচরিতধারায় তিনি আশ্চর্য ব্যতিক্রম। প্রাণশক্তির স্বতঃস্ফূর্ত ধারায়, যৌবনের উদ্দাম গতিবেগে,হৃদয়ের সজীবতায়, বিপ্লবের উদ্দীপ্ত কণ্ঠস্বরে নজরুল বাংলা সাহিত্যে জাগালেন এক অভিনব সুর। এক অদম্য প্রাণ-প্রবাহ। তাঁর লেখনীতে মূর্ত হয়ে উঠল বন্ধন মুক্তির দুর্বার আকাঙ্ক্ষা।অনমনীয় পৌরুষে প্রদীপ্ত তারুণ্যের প্রবক্তা নজরুল বিদ্রোহের কবি, বিপ্লবের কবি, প্রেমের কবি, তারুণ্যের কবি, প্রকৃতির কবি, সাম্যের কবি সর্বোপরি মানুষের কবি।
রবিকরোজ্জ্বল বাংলা সাহিত্যের ললিত কোমল অঙ্গনে তিনি প্রথম শুনালেন বিদ্রোহের উদ্দীপ্ত ঝংকার-
"আমি চির বিদ্রোহী বীর _
বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির উন্নত শির।" (বিদ্রোহী)
বহুবিচিত্রধারায় অভিব্যক্ত হয়েছে নজরুল প্রতিভা। কবি, অনুবাদক, শিশু সাহিত্যিক, নাট্যকার, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, প্রভৃতির সাথে গীতিকার ও সুরকার নজরুল আপন মহিমায় ভাস্বর। নজরুলের সঙ্গীত -ভাণ্ডার অনবদ্য। বাংলা গানে রবীন্দ্রনাথের পরেই নজরুলের স্থান। রবীন্দ্রনাথের মত সংগীতে নজরুল প্রতিভা শতধারায় উৎসারিত হয়ে মাধুর্য এবং মূর্ছনায় সর্বাধিক স্ফূর্তি লাভ করেছে। তাঁর কাব্য- প্রতিভার সাথে গীতি প্রতিভার শুভ সংযোগ ঘটেছে। আর বাংলা সংগীত লাভ করেছে এক অনন্য প্রদীপ্তি। বাণীর ঐশ্বর্য এবং সুরের মাধুর্য এ দুয়ের মণিকাঞ্চনযোগে নজরুলের গান অতুলনীয়, একথা বলাই বাহুল্য।
বিষয়বৈচিত্র্যে নজরুল সংগীত বহুমাত্রিক আলোকে উজ্জ্বল।তাঁর সংগীতের বিষয়বস্তুতে আছে প্রেম, স্বদেশপ্রীতি, রাগরাগিণী,হাসি, প্রকৃতি,হিন্দু ঐতিহ্য, মুসলিম ঐতিহ্য ইত্যাদি।
ইসলাম ধর্মের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে নজরুল রচিত গানের সংখ্যা দুই শতাধিক। এ বিষয়ে সঙ্গীত-গবেষক করুণাময় গোস্বামী বলেন, -"বাংলা কাব্য সঙ্গীতের সমুন্নত ধারায় ইসলামী ভক্তিগীতি রচনার ক্ষেত্রে নজরুল ইসলাম পথিকৃৎ ভূমিকা পালন করেছিলেন।"
এসব ইসলামি সংগীতে মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আজহার মূল সুর অর্থাৎ ত্যাগ -তিতিক্ষার বিষয়টি দিব্য রাগে ফুটে ওঠেছে। আকাশে ইদের চাঁদ দেখে কবি মনে খুশির জোয়ার। তিনি ইসলামের মর্মমূলে প্রবেশ করতে পেরেছিলেন বলেই ইসলামের প্রকৃত বিধান বিষয়ে সংগীতে ফুটেছে সুরেলা অভিব্যক্তি,
"ঈদজ্জোহার চাঁদ হাসে ঐ
এল আবার দুসরা ঈদ
কোরবানী দে কোরবানী দে
শোন খোদার ফরমান তাকীদ।।
এমনি দিনে কোরবানী দেন পুত্রে হযরত ইব্রাহীম,
তেমনি তোরা খোদার রাহে
আয়রে হবি কে শহীদ।"
নজরুল মানুষের কবি।দেশের তথা সারাবিশ্বের বঞ্চিত, নিপীড়িত মানুষের জন্য সুগভীর মমত্ববোধ তাঁর কাব্যের অপ্রতিরোধ্য প্রেরণা। মানুষে মানুষে বিভেদ, বৈষম্য সংবেদনশীল কবিকে বারবার ব্যথিত করেছে। তিনি আহত হয়েছেন প্রতিনিয়ত।ইদের ঝিলিমিলি আনন্দের মাঝেও তাঁদের তিনি বিস্মৃত হননি।সংগীতে তাই অনিবার্যভাবে সাম্য মৈত্রীর ছায়াপাত ঘটেছে -
"ঈদজ্জোহার তকবীর শোন্ ঈদগাহে!
(তোর) কোরবানীরই সামান নিয়ে চল্ রাহে।
...
তোর পাশের ঘরে গরীব কাঙাল কাঁদছে যে
তুই তাকে ফেলে ঈদগাহে যাস সঙ সেজে,
শোন
কেঁদে কেঁদে বেহেশত হ'তে হজরত আজ কি চাহে।।"
আত্মিক পরিশুদ্ধি আর সুন্দরতাই কবির একমাত্র কাম্য। মনের সকল কালিমা,ম্লানিমা আজ ধুয়ে মুছে যাক।সত্য, সুন্দর আর কল্যাণ কাঙ্ক্ষায় কবির উদাত্ত আহবান-
"মনের মাঝে পশু যে তোর
আজকে তা'রে কর জবেহ,
পুলসেরাতের পুল হ'তে পার
নিয়ে রাখ আগাম রসিদ।।"
একথা অনস্বীকার্যযে, অন্যান্য সৃষ্টির পাশাপাশি নজরুল সংগীতের একটা বিরাট অংশ মুসলিম ঐতিহ্যের ধারক বাহক হয়ে কবিকে আপন স্বাতন্ত্র্যে ভাস্বর করে রেখেছে।সংগীতের তরঙ্গ হিল্লোলে কবি বারবার স্মরণ করেছেন ইসলামের অমিয় বাণীর কথা।সংযম এবং আত্মশুদ্ধির পথে উদাত্ত আহবান জানিয়েছেন। তাঁর লেখার ধার যেমন তীক্ষ্ণ, ভারও তেমনি প্রচণ্ড। ইসলামের বিভিন্ন বিধিবিধান পালনের প্রতি কবি বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন।এ ব্যাপারে তিনি অবিচল,উচ্চকণ্ঠ। পশু কোরবানির মাধ্যমে প্রকৃত ত্যাগ এবং শুদ্ধি আসেনা।প্রকৃত মানুষ হওয়ার সাধনায় কাম,ক্রোধ প্রভৃতি রিপু
দমনে সার্থকতার মধ্য দিয়েই মানব জীবন সুরভিত আর জ্যোতিষ্মান হতে পারে।সংযমের কঠোর সাধনার পথ বেয়েই আসে মুক্তির চির কাঙ্ক্ষিত ধন। এ বিষয়ে কবির আস্থা অবিচল-
"নতুন চাঁদের তকবীর শোন,কয় ডেকে ঐ মুয়াজ্জিন।
আসমানে ফের ঈদজ্জোহার চাঁদ উঠেছে মুসলেমিন।।
এল স্মরণ করিয়ে দিতে ঈদজ্জোহার এই সে চাঁদ,
(তোরা) ভোগের পাত্র ফেলরে ছুঁড়ে, ত্যাগের তরে হৃদয় বাঁধ।।
কোরবানী দে তোরা,কোরবানী দে।।
...
কি হবে ঐ বনের পশু খোদারে দিয়ে
(তোর) কাম ক্রোধাদি মনের পশু জবেহ কর নিয়ে।
কোরবানী দে তোরা,কোরবানী দে।।"
সবশেষে আমরা বলব, নজরুল প্রতিভার সর্বশ্রেষ্ঠ প্রকাশ সংগীতে। সুরের ইন্দ্রজাল, বাণীর মাধুর্য তথা সার্বিক দিক থেকেই নজরুল সংগীত দোসরহীন।অনন্য সুন্দর।এ প্রসঙ্গে প্রতিথযশা নজরুল গবেষক ড.সুশীলকুমার গুপ্তের উক্তিটি স্মরণ যোগ্য,"বাংলার সংস্কৃতিজীবনের দুটি বিশেষ ক্ষেত্র,সাহিত্য ও সংগীত বিভাগ নজরুলের অসামান্য দানে সমৃদ্ধ হয়েছে।"
একথার বর্ণিল প্রতিচ্ছবি দেখা যায় ইদুল -আজহা বিষয়ক সংগীত সম্ভারে।
তথ্যসূত্র
১. নজরুল -গীতি(অখণ্ড)
সম্পাদনা
আবদুল আজীজ আল
আমান (১৯৯৩)।
২. বাংলা সংস্কৃতির শত বর্ষ,
সম্পাদক
করুণাময় গোস্বামী,
১৪০০সাল।
৩. নজরুল চরিত মানস,
ডক্টর সুশীলকুমার গুপ্ত, ১৯৯৭।
লেখক : জাহান আরা খাতুন, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ, হবিগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজ, হবিগঞ্জ।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Suprobhat Michigan